প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আটক বেল্লাল রাঢ়ী (১৮) নামে এক তরুণকে শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের পর সালিশ বিচারে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে তাকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জুতার মালা পরিয়ে এলাকায় ঘোরানো হয়।
বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) রাতে ওই তরুণকে আটক করা হয় এবং শুক্রবার সকালে তাকে নিয়ে সালিশ বৈঠকে বসা হয়। ঘটনাটি ঘটেছে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেয়ারচর গ্রামে।
নির্যাতনের শিকার বেল্লাল মেয়ারচর গ্রামের আলম রাঢ়ীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, বেল্লালদের পরিবার ও একই গ্রামের জসিম আকনের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এসবের মধ্যে জসিম আকনের মেয়ের (১৭) সঙ্গে বেল্লালের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছুদিন আগে জসিম ও তার দুই ছেলে স্বপন এবং রিপন বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর বেল্লালের ওপর তাদের ক্ষো আরও বেড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বেল্লাল তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য লুকিয়ে তাদের বাড়ি পাশের বাগানে যায়। এ সময় প্রেমিকার দুই ভাই তাকে ধরে ফেলেন এবং লাঠিসোটা দিয়ে বেদম মারধর করেন। একপর্যায়ে বাড়ির উঠানে একটি গাছের সঙ্গে শিকলে তালা দিয়ে বেল্লালকে আটকে রাখা হয়। ওই অবস্থায় সারারাত তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়।
স্থানীয়রা আরও জানান, শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জসিম আকনের বাড়িতে সালিশ বিচার বসে। সেখানে গ্রামের প্রভাবশালী মামুন চৌকিদার, জসিম খান, কবির খাঁ, আনোয়ার চৌকিদার ও মো. জহিরসহ আরও কয়েকজনকে বিচারের জন্য ডাকা হয়। এ সময় জসিম আকনের পরিবারের পক্ষ থেকে বেল্লালের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। পরে সালিশ বিচারে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর বেল্লালকে জুতার মালা পরিয়ে জসিম আকনের বাড়ির আশেপাশের এলাকায় ঘোরানো হয়।
বেল্লালের বড় ভাই ছালাম রাঢ়ী বলেন, ‘জসিম আকনের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পূর্ব বিরোধ ছিল। গতকাল রাতে আমার ছোট ভাই বেল্লাল তার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় স্বপন, রিপন ও তাদের চাচাতো ভাই নুরুজ্জামান বেল্লালকে ধরে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। এরপর তাকে সারারাত শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে আটকে রাখে এবং মারধর করে। সকালে খবর পেয়ে সেখানে গেলে তারা বেল্লালের সালিশে বিচার করা হবে বলে জানায়। সালিশ বিচারে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হয়।’
ছালাম আরও বলেন, ‘বিচারের সময় সালিশদারদের বার বার অনুরোধ করেছি, আমার ভাই কোনো অপরাধ করে থাকলে তাকে পুলিশে দেন। জসিম আকনের টাকা আছে। এলাকায় তার প্রভাব আছে। সালিশদাররা সবাই জসিম আকনের পক্ষে কথা বলেছেন। আমার কথা কেউ শোনেননি। জসিম আকন যে শাস্তির কথা বলেছেন, সালিশদাররা সেই শাস্তি আমার ভাইকে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘জরিমানার ৭০ হাজার টাকার মধ্যে ৪০ হাজার টাকা সালিশদারদের হাতে তুলে দিয়েছি। এ সময় সালিশদাররা হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে বেল্লালের চিকিৎসা করানোর জন্য বলেন। তারা এ নিয়ে থানায় অভিযোগ দিতে নিষেধ করেন। তারা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে সমস্যা হতে পারে। ক্ষতির আশঙ্কা আছে। এজন্য সালিশে যে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে, তা যেন মেনে নেই। আমরা গরিব। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের পক্ষে। সালিশের বিচার মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। গ্রামে তাদের শত্রু হয়ে থাকা যাবে না। তাই বাধ্য হয়েই সালিশদারদের বিচার মথা পেতে মেনে নিতে হয়েছে।’
ছালাম আরও বলেন, ‘বাড়িতে আমার ভাই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভয়ে ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে সে। তবে জসিম আকনের লোকজনের হুমকির কারণে হাসপাতালে নিতে সাহস পাচ্ছি না।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে জসিম আকন ও তার ছেলে স্বপনের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে তাদের এক স্বজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, সালিশে জরিমানার ৪০ হাজার টাকা বেল্লালের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হলেও ওই অর্থ তরুণীর পরিবার পায়নি।
সালিশ বিচারে অংশ নেয়া মামুন চৌকিদারের দাবি, ‘মেয়ের অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সালিশ বসিয়ে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। মেয়ের বাড়িতে আটক থাকা বেল্লালকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন সালিশদাররা। এখানে কোনো জরিমানার টাকা আদায় করা হয়নি।’
এ বিষয়ে শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হুমায়ুন গাজী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকেলে বেল্লালের বড় ভাই ছালাম আমার কাছে এসে ঘটনার কথা বলেছেন। আমি তাকে পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, দেশে আইন আছে। আদালত আছে। কেউ যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে, তাকে পুলিশে দেয়া উচিৎ। এরপর আদালত তার বিচার করবে। এভাবে সালিশ করে বিচার করা ঠিক নয়।’
মেহেন্দিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবুল কালাম জানান, ‘সন্ধ্যার পর বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। তবে ওই এলাকা অনেক দুর্গম। সকালে সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’